ভারত রাশিয়ার তেল কেনায় কি ডলারের আধিপত্য কমছে?
ইউক্রেন আগ্রাসনের শুরু থেকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। রুশ তেলের ওপরও বিভিন্নভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে তারা। এ কারণে প্রেক্ষাপটে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। কয়েক দশক ধরে আধিপত্য রাখা আন্তর্জাতিক মুদ্রা অর্থাৎ মার্কিন ডলারে বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রায় তেল বিক্রি করছে রাশিয়া। আর এতেই আধিপত্য কমেছে ডলারের। আজ বুধবার (৮ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স।
লন্ডনভিত্তিক সংবাদ সংস্থাটি বলছে, নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই ইউরোপে জ্বালানি রপ্তানি কমিয়েছে রাশিয়া। এমনকি দেশটির মুদ্রা রুবলে রপ্তানির কথা জানিয়েছে তারা। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে জ্বালানি বিক্রিতে রাশিয়া যে চুক্তিগুলো করেছে, তা হয়েছে আন্তর্জাতিক ছয় মুদ্রার বাইরে। এতে করে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য করা মার্কিন ডলারের আধিপত্য খর্ব হয়েছে।
ইউক্রেন আগ্রাসনের পর থেকেই আমদানি-রপ্তানিতে ডলারের প্রাধান্য নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বহুবার। তবে, ব্যবসার জন্য সর্বাধিক বহুল স্বীকৃত মুদ্রাটি ব্যবহারের অপ্রতিরোধ্য সুবিধার কারণে এটিতে লেনদেন অব্যাহত রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার তেল বাণিজ্য, নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া অন্যান্য মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি ডলারের খর্বতার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। অন্যান্য মুদ্রায় লেনদেন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এটি স্পষ্ট হচ্ছে।
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এটিকে বিশেষ সামরিক অভিযান বলে অভিহিত করছে মস্কো। এই যুদ্ধের আগে রাশিয়ার সিংহভাগ জ্বালানি যেত ইউরোপের দেশগুলোতে। তবে, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এতে পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের তৃতীয় তেল আমদানিকারক দেশ ভারতে যাচ্ছে রাশিয়ার বেশিরভাগ তেল।
গত ৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার সমুদ্রজাত তেলের দাম ৬০ ডলারে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এতে সায় দেয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া। এরপর থেকেই ভারতে রাশিয়ার তেল বিক্রিতে ডলারের পরিবর্তে নতুন মুদ্রার আবির্ভাব হয়। তেল বিক্রির বেশিরভাগ অর্থ আরব আমিরাতের মুদ্রা দিহরামে পরিশোধ করে ভারতের তেল আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া রুবল দিয়েও তেল বিক্রির লেনদেন হয়। ব্যাংকিং সূত্র রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
ওই সূত্র বলেন, ‘সর্বশেষ তিন মাসে জ্বালানি বিক্রি নিয়ে রাশিয়াকে তেলের জন্য ভারতের ব্যবসায়ীরা কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের সমতুল্য পরিমাণ মুদ্রা পরিশোধ করেছে।’
বিষয়টি নিয়ে সরাসরি জ্ঞাত তিনটি সূত্র জানিয়েছেন, কিছু দুবাইভিত্তিক ব্যবসায়ী ও রাশিয়ার জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রম এবং রনসেফ্ট রুশ তেলের নির্দিষ্ট বিশেষ গ্রেডের জন্য নন-ডলার পেমেন্ট চাইছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়ার প্রতি ব্যারেল সমুদ্রজাত তেল বিক্রি হয়েছে ৬০ ডলারের ওপরে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তারা রয়টার্সকে তাদের নাম না প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।
রয়টার্স বলছে, রাশিয়ার যত তেল ভারত আমদানি করেছে তা এই সময়ের তুলনায় খুবই সামান্য। এমনকি তেল কিনে ভারত পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেনি বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য সূত্রের পাশাপাশি সাবেক রাশিয়ান ও মার্কিন অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সর্বশেষ লেনদেনে জড়িত ছিল ভারতের তিনটি ব্যাংক। লেনদেনের জন্য রাশিয়া ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রার জন্য জোর দেয়।
গত মাসে আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য আবুধাবিভিত্তিক রাশিয়ান ব্যাংক এমটিএসর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর ফলে দিরহামে লেনদেন কিছুটা কমতে পারে। ওই সূত্র জানিয়েছে, কিছু ভারতীয় ব্যবসায়ীকে রুশ তেলের অর্থ পরিশোধে ডলারের পরিবর্তে অন্য মুদ্রায় লেনদেন করতে সহায়তা করেছে এমটিএস। তবে, বিষয়টি নিয়ে এমটিএস কর্তৃপক্ষ ও মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ভারতে তেল পরিশোধনের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, ‘আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়ার বেশিরভাগ ব্যাংক কালো তালিকায় রয়েছে। তবে, রাশিয়ান সরবরাহকারীরা ও ভারতের আমদানিকারকরা মস্কোর তেল ব্যবসা চালাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
রাশিয়ান সরবরাহকারীরা অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক খুঁজে পাবে জানিয়ে ওই সূত্র বলে, ‘ভারত সরকার আমাদের তেল কিনতে বারণ করছে না। তাই আমরা আশাবাদী, বর্তমান সিস্টেমটি বন্ধ হয়ে গেলেও আমরা বিকল্প পথ পেয়ে যাব।’
প্রতিবেদনে রয়টার্স আরও জানায়, জ্বালানি আমদানি-রপ্তানিতে এখনও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ডলার। কয়েক দশক ধরেই এটি প্রথা আকারে চলে যাচ্ছে। আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে বার্তা আদানপ্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সুইফটের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ৪০ শতাংশই ডলারে হয়। তবে, এটি আগের তুলনায় কম।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল আহন বলেন, ‘ডলারের শক্তি তুলনাহীন। কিন্তু, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। ডলার ব্যতীত অন্যান্য মুদ্রার বিনিময়ে পণ্য বিক্রির জন্য রাশিয়ার স্বল্পমেয়াদী প্রচেষ্টা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আসল হুমকি নয়।’