যুক্তরাষ্ট্রের ‘আক্রমণাত্মক’ ভিসা নিষেধাজ্ঞায় চীনা শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলা চীনা শিক্ষার্থীরা এখন আতঙ্ক, অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সেই সঙ্গে ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্ষোভও বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের “চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা কঠোরভাবে বাতিল” করার ঘোষণার পর এই আতঙ্ক ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। খবর সিএনএনের।
কম্পিউটার সায়েন্সের পিএইচডি শিক্ষার্থী ‘কিউই ঝাং’ সম্প্রতি এই নীতির শিকার হন। গবেষণা উপস্থাপন শেষে এশিয়া থেকে ফেরার সময় মার্কিন সীমান্তে আটক হন তিনি। ৪৮ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস জব্দের পর তাঁকে চীনের সঙ্গে গবেষণা ভাগাভাগির সন্দেহে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং ৫ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
কিউই ঝাং বলেন, “আমি কখনও ভাবিনি এমন কিছু আমার সঙ্গে ঘটবে। ট্রাম্প ফেরার পর পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা কল্পনাও করিনি।”
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণা অনুযায়ী, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা “গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে” অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি যদিও স্পষ্ট নয়, তবে তা চীনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বৈষম্যমূলক” বলে আখ্যা দিয়েছে।
বাড়ছে অবিশ্বাস ও বৈরি মনোভাব
বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার আকর্ষণে চীনের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যেতেন। কিন্তু এখন দুই দেশের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগ ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।
২০২০ সালে ট্রাম্প প্রশাসন প্রথমবার চীনের সামরিক সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ভিসা নিষিদ্ধ করে। সে সময় তিন মাসেই এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল হয়।
এখন ফের সেই কড়াকড়ি ফিরে এসেছে। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ছাত্ররা গভীর দুশ্চিন্তায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্টের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বীয় রসায়নে পিএইচডি করছেন ডেভিড ইয়াং। তিনি বলেন, “রুবিওর ঘোষণার পর আমরা কেউই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারিনি। আমি একপ্রকার হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।”
ভিসা জটিলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য
ভবিষ্যতের ভিসা বাতিল হওয়ার শঙ্কায় ইয়াং এই শীতে চীন না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তাঁর বিভাগ “গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তাছাড়া তিনি কমিউনিস্ট ইয়ুথ লীগ সদস্য, যেটা চীনে প্রায় সব ছাত্রই হন।
ইয়াং বলেন, “এটা যেন সব চীনা শিক্ষার্থীকেই সন্দেহের চোখে দেখার নামান্তর।”
ভিসা বাতিল হওয়া ঝাং বলেন, কর্মকর্তারা তাঁর বাবা-মার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার তথ্য জানতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর নিজস্ব সদস্যপদ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। “আমি বলেছিলাম, কোনো কার্যক্রমে জড়িত ছিলাম না, শুধু নামমাত্র সদস্য ছিলাম। কিন্তু তারা বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছো।’ আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।”
বিকল্প ভাবনা
এই অবস্থায় অনেকেই ইউরোপ, কানাডা কিংবা হংকংয়ের দিকে নজর দিচ্ছেন। গণিতের ছাত্রী এলা লিউ বলেন, “আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা নিয়ে। কিন্তু এখন ভাবছি ফ্রান্স বা হংকংয়ের মতো জায়গায় পড়াশোনা করবো।”
এক শিক্ষা পরামর্শক বলেন, “আগে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ‘সোনার মানদণ্ড’। এখন অনেকেই কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার কথা ভাবছেন।”
তবুও ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর মোহ কাটেনি সবার
চীনের উপকূলীয় ফুজিয়ান প্রদেশের ব্যবসায়ী আর্নো হুয়াং এখনো চান তাঁর সন্তানরা আমেরিকায় পড়ুক। “যুক্তরাষ্ট্র এখনও সবচেয়ে উন্নত ও সভ্য দেশগুলোর একটি। এখনকার সংকট একসময় ঠিক হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পুরোনো উষ্ণতার স্মৃতিচারণ করে এক গবেষক বলেন, “চীনা কর্মকর্তাদের একটা প্রজন্ম ছিল যারা আমেরিকা থেকে ফিরে এসে কেবল ডিগ্রি নয়, একটি মুক্তচিন্তার মানসিকতা নিয়েও ফিরেছিল। সেটাই ছিল আমেরিকার আসল শক্তি।”
চীনা শিক্ষার্থীরা এখন এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে তাঁদের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দোলাচলে। আর আমেরিকান উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন আজ অনেকের কাছেই এক অনিশ্চয়তার নাম।