যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কতটা পিছিয়ে দেবে?

ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় রোববার (২২ জুন) ভোরে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলা ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করেছে। গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের মধ্যে এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্পের ন্যায্যতা ও হামলার লক্ষ্য
রোববার ভোরে এক টেলিভিশন ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার ন্যায্যতা প্রমাণ করে বলেছেন, ইরানের ‘পারমাণবিক হুমকি’ বন্ধ করার লক্ষ্যে এটি চালানো হয়েছে। হামলায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন বা সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত নাতানজ, ইসফাহান ও ফোরদো স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, ‘আমি বিশ্বকে জানাতে পারি—এই হামলাগুলো একটি দর্শনীয় সামরিক সাফল্য ছিল। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।’ তিনি তেহরানকে প্রতিশোধ না নেওয়ার জন্য সতর্কও করেছেন।
ইসরায়েল ও ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইরান পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরির জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করতে পারে। তবে, ইরান জোর দিয়ে বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল বেসামরিক উদ্দেশ্যে।
জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ইসরায়েলি দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া : ‘কূটনীতির সময় শেষ, আত্মরক্ষার অধিকার’
মার্কিন কর্মকর্তারা এই হামলাগুলোকে অত্যন্ত সমন্বিত বলে অভিহিত করেছেন। এর নিন্দা জানিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, কূটনীতির সময় শেষ হয়ে গেছে, তার দেশের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে আরাঘচি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের একটি আইনহীন প্রশাসন ও যুদ্ধবাজ। তাদের আগ্রাসনে বিপজ্জনক ও সুদূরপ্রসারী পরিণতির জন্য এককভাবে, সম্পূর্ণরূপে দায়ী।’
ইরানের কর্মকর্তারা অবশ্য ক্ষতির পরিমাণ বিস্তারিতভাবে জানাননি। তারা আঘাতের তাৎপর্য কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। রাষ্ট্রীয় টিভিতে দেওয়া বক্তব্যে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকের উপ-রাজনৈতিক পরিচালক হাসান আবেদিনি বলেছেন, তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা ‘কিছুক্ষণ আগে’ খালি করা হয়েছে। তারা ‘বড় কোনো আঘাতের সম্মুখীন হয়নি, কারণ উপকরণগুলো ইতিমধ্যেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে’।
কোন স্থাপনাগুলোতে আঘাত করা হয়েছিল? ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
ট্রাম্প বলেছেন, বোমা ইরানের ফোরদো, নাতানজ ও ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। ইরানি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বোমা ইরানের তিনটি স্থাপনায় আঘাত করেছে।
সাইটগুলো কি ধ্বংস করা হয়েছে?
ফোরদোতে মার্কিন হামলার স্বাধীন প্রভাব মূল্যায়ন এখনও অস্পষ্ট। রোববার (২২ জুন) যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক মূল্যায়ন হল—আমাদের সব নির্ভুল অস্ত্র যেখানে আমরা আঘাত করতে চেয়েছিলাম সেখানে আঘাত করেছে ও কাঙ্ক্ষিত প্রভাব অর্জন করেছে।
একজন ইরানি আইনপ্রণেতা আল জাজিরাকে বলেছেন, সাইটটির উপরিভাগে ক্ষতি হয়েছে। আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসির মতে, গত সপ্তাহে ইসরায়েলি হামলার ফলে ভূগর্ভস্থ প্ল্যান্টে সীমিত ক্ষতি হয়েছে।
রোববারের হামলার পর নাতানজে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও স্পষ্ট নয়। এর আগে ইসরায়েলি হামলায় ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি `সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস‘ হয়ে গিয়েছিল। তবে ইউরেনিয়াম বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ অংশে থাকা সেন্ট্রিফিউজগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হলেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদিও এটি সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছিলেন গ্রোসি।
এদিকে, আইএইএ রোববার জানিয়েছে, মার্কিন হামলার ফলে ইসফাহানে ছয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে দূষিত সরঞ্জাম পরিচালনার একটি কর্মশালাও রয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ওই স্থানে চারটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্ল্যান্টের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারও রয়েছে।
ইরান ও কুয়েতের মতো প্রতিবেশী উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক প্রতিবেদনে আরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থের কোনো উল্লেখযোগ্য লিকেজ হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর থেকে বোঝা যায়, ইরানি কর্মকর্তারা মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে থাকা স্থাপনাগুলো থেকে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
ইরনা সংবাদ সংস্থার মতে, ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার উপ-পরিচালক ও দেশটির জাতীয় পারমাণবিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন্দ্রের প্রধান রেজা কারদান নিশ্চিত করেছেন, কোনো বিকিরণ দূষণ বা পারমাণবিক বিকিরণ সাইটের বাইরে পরিলক্ষিত হয়নি। দেশের প্রিয় জনগণের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্টের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেছেন, সম্ভবত ইরান মার্কিন হামলার আগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, মনে হচ্ছে তারা ইতিমধ্যেই একটি আগাম সতর্কতা পেয়ে গিয়েছিল।
এটি কি ইরানের পারমাণবিক প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে?
ইরানের সামগ্রিক পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর হামলার প্রভাব এখনও অজানা। তবে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে অস্ত্রায়নে পৌঁছাতে এতদূর এগিয়েছে তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই।
পারসি বলেন, ইরানের সবচেয়ে মূল্যবান পারমাণবিক সম্পদ হল সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ। যতক্ষণ তাদের কাছে এটি থাকবে, ততক্ষণ তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি থাকবে। আমার মনে হয় আমরা খুব শিগগিরই ইসরায়েলিদের কাছ থেকে শুনতে শুরু করব, ট্রাম্প যে ধরনের সফল হামলার দাবি করেছেন তা নয়, তবে তারা এই যুক্তি তৈরি করতে শুরু করবে—ইরানের বিরুদ্ধে আরও বোমা হামলা চালানোর প্রয়োজন।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কি এর আগেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে?
ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল। শাহের মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জ্বালানি উৎপাদন ও কিছুটা হলেও অস্ত্র তৈরির জন্য ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স সবাইই দেশটিকে সহায়তা এবং প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করেছিল। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে নতুন সরকার কর্মসূচির কিছু অংশ বন্ধ করে দেয় বা স্থগিত করে। যুক্তি দেয় যে, এটি ব্যয়বহুল ও এটি পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর ইরানের অব্যাহত নির্ভরতার প্রতিনিধিত্ব করে।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময় স্থগিত বা বাতিল করা কর্মসূচি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যখন ইরাক আক্রমণের পর দেশটিকে যুদ্ধের প্রচেষ্টায় সম্পদ স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয়। শিল্প উৎপাদনকারী জায়ান্ট সিমেন্সের সঙ্গে অংশীদারিত্বের অংশ হিসেবে নির্মাণাধীন বুশেহর পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনাটি ইরাক কর্তৃক মারাত্মকভাবে বোমা হামলার শিকার হয় এবং প্রায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিমেন্স অবশেষে প্রকল্প থেকে সরে আসে। সরকার পরবর্তীতে পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় চালু করবে বলে জানা গেছে, যদিও ইরানের নেতৃত্ব সর্বদা জোর দিয়ে বলে আসছে যে, তারা বেসামরিক ব্যবহারের জন্য পারমাণবিক শক্তি অর্জন করছে।

২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তির (যা আনুষ্ঠানিকভাবে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন নামে পরিচিত) অধীনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে দেশটিকে তার সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা সীমিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইরান, চীন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে সমৃদ্ধকরণের মাত্রা তিন দশমিক ৬৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
আইএইএ অনুসারে তেহরান চুক্তির শর্তাবলি মেনে চলে। এটি আইএইএ-কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিতেও সম্মত হয়েছিল। তবে, ট্রাম্প ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন এবং সর্বোচ্চ চাপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। যার ফলে তেহরানও শর্তাবলি বাতিল করতে বাধ্য হয়। যদিও এটি আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখে।